শুজা রশীদ : (পর্ব ৪৫)
৬৪
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। বেশ ঠান্ডা পড়েছে টরন্টোতে। দুই ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ড্যানফোর্থে নিজের দোকানে এলো রিমা। দোকানটা একটা ছোট স্ট্রিপ মলের অংশ। আরোও আধা ডজন দোকান আছে এখানে। ওর পাশের দোকানটা একটা কনভেনিয়েন্স স্টোর, তার পরেরটা সস্তা কাপড়ের দোকান, তার ওপাশে একটা থ্রিফট শপ, একটা আফগানী রেস্টুরেন্ট এবং সবশেষে এক উকিলের অফিস। মলের সামনে এবং পেছনে যথেষ্ট পার্কিং আছে।
সকাল নয়টায় একমাত্র কনভেনিয়েন্স স্টোরটাই খোলা। নিজের দোকানের দিকে যেতে যেতে একবার দ্রুত সেটার ভেতরে নজর বোলাল রিমা। এক ভারতীয় যুবক দোকানে কাজ করছে। জাফর ওকে বলেছে দোকানটা কেরালা থেকে আসা একটা ভারতীয় পরিবারের মালিকানাধীনে আছে। স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের একমাত্র ছেলেই কাজ করে দোকানে। তারা চমৎকার মানুষ এবং রিমার কখন কোন প্রয়োজন হলে সে নির্দ্বিধায় তাদের সাথে আলাপ করতে পারে। তারা এই এলাকায় বেশ কিছু বছর ধরে দোকান চালাচ্ছে, কোন সমস্যা হলে কিভাবে সামাল দিতে হয় জানে।

রিমা নতুন করে আর কোন সমস্যা চায় না। সমস্যার কথা মনে হলেই ওর নাড়ী চিড়বিড় করে ওঠে। সিদ্ধান্ত নিল মহিলা দোকানে এলে নিজেই গিয়ে তার সাথে পরিচিত হবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েরা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। যুবকটা নিশ্চয় তাদের ছেলেই হবে। রোগা, কালো, নিরীহ, ভালোমানুষি ভরা মুখটা। খানিকটা কালামের মতই দেখতে। কিন্তু ইদানীং কালামকে দেখে আর নিরীহ মনে হয় না। কালাম কারো সাথে মারপিট করছে এই দৃশ্য মনে হলেও রিমার হাসি পায়। কালামকে দেখলে মনে হয় কত গোবেচারা, ভাঁজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না।

দোকানের শাটারটা দুইটা ঝোলানো তালা দিয়ে আটকানো থাকে। খুলতে একটু কষ্টই হয়। শাটার ধরে ঠেলাঠেলি করতে করতে নিজের কাছেই অবাক লাগে রিমার- সে সত্যি সত্যি একটা দোকানের মালিক হয়ে গেল! জীবনে কোন দিন ভাবেনি সে বাস্তবিকই একটা ব্যবসা খুলে বসবে, তাও আবার মলের মধ্যে একটা দোকান নিয়ে! ওর যেমন বিস্মিত লাগে তেমনি ভীতিবোধও জাগে। বাড়িতে ডাউন পেমেন্ট দেবার পর অর্থ যা বেঁচেছিল তার অধিকাংশই এই দোকানে ঢেলে দিয়েছে ও। সবাই যে ওর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে তা নয়। এই এলাকায় ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশী কাপড়ের দোকান আছে। সারা টরন্টোতে রয়েছে প্রচুর। কিছু কিছু দোকান ভালো চললেও অনেকগুলোই ধুঁকে ধুঁকে চলছে। কেউ কেউ আবার ওকে বলেছে ব্যবসায়ে ভালো করার জন্য কিঞ্চিৎ ভাগ্যের প্রয়োজন আছে। ব্যবসা বানিজ্য সবার সমান ভাবে হয় না।

ওর কাছে এটা অবশ্য একটা স্বপ্ন পূরণের মত। নিজের পছন্দের কাজ নিজের মত করে করতে পারাটা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া দরকার হলে মিলা এবং ফায়জাকেও এই ব্যবসায়ে জড়িয়ে ফেলতে পারবে। ওর পরিচিত মহিলাদের মডক্সেও কেউ যদি যোগ দিতে চায় তাদেরকে সে সাদরে গ্রহণ করবে। তার এই ক্ষুদ্র কাপড়ের দোকান হয়ে উঠতে পারে ওর সমসাময়িক স্থানীয় নারীদের প্রগতির কেন্দ্র। ওর প্রধাণ উদ্দেশ্য হবে তাদেরকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য সহযোগীতা করা। নিজের মধ্যে ও এক নতুন ধরণের উৎসাহ এবং উদ্দীপনা অনুভব করে।

শাটারটাকে ঠেলে উপরে তুলতে একটু শক্তি লাগে। জাফর ওকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে তালা খুলে শাটার খুলতে হয়। তার উপস্থিতিতে ও নিজেও কয়েকবার করেছিল। কিন্তু কারো সাথে করা আর সম্পূর্ণ একাকী করার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। তারপরও কোন একভাবে পদ্ধতিটা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে। দোকানের সামনের দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের। মাঝে কাঁচের দরজা। সেটার আলাদা তালা-চাবি আছে।

চাবি দিয়ে কাঁচের দরজা খুলে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করল ও। বিশ বাই পনের ফুটের একটা কামরা, মাঝে খান দুই টেবিল পড়ে আছে। আগের মালিক ফেলে গেছে, ওর অনুরোধেই। তাদের ছিল মিষ্টির দোকান। এখানে ব্যবসা খুব একটা ভালো চলে নি। ব্যাংকরাপটসি ঘোষনা করেছে তারা।

দোকানের পেছনের অংশে রয়েছে আলাদা স্টোরেজ, যেটার আকার মূল দোকানের অর্ধেকটা হবে। আপাতত সেখানে কিছুই নেই। রিমা দরজা বন্ধ করে চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল স্থানটাকে ব্যবসার জন্য প্রস্তুত করতে কতখানি কাজ করতে হতে পারে। বেশ কয়েক মাস ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে স্থানটা। দেয়ালগুলো মলিন হয়ে গেছে। পরিষ্কার করে এক প্রস্থ রঙের পরত দিতে পারলে সুন্দর লাগবে। লাইট ফিচারগুলোও পালটে ফেলতে হবে। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ সাজিয়ে রাখার জন্য কিছু শেলফ এবং র‌্যাক বানাতে হবে। ওর ইচ্ছা নিজেও ছেলে-মেয়েদের পোশাক ডিজাইন করবে, পূর্ব এবং পশ্চিমের মিশ্রনে চমৎকার, চোখ ধাঁধান পোশাক। এখানে অনেকেই বহুল পরিচিত ব্র্যান্ডের পোশাক কিনতে দ্বিধা করে কারণ সেগুলো অতিমাত্রায় সংক্ষিপ্ত, বিশেষ করে অল্প বয়স্ক মেয়েদের জন্য। রিমার ইচ্ছা কিছু নতুন ধরনের ডিজাইন এনে সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করা।

মিলার আসার কথা ছিল কিন্তু তার কোন খবর নেই। কয়েকবার ফোন দিয়েছে রিমা কিন্তু বার বার ভয়েস মেইলে চলে যাচ্ছে। পরবর্তি সোমবারের আগে কাজে ফেরার কথা ছিল না মিলার। রিমার আশংকা মেয়েটা আবার গাঁজা টেনে আয়েস করে মনের দুঃখে কাঁদতে বসেছে কিনা। দোকান সাজাতে মিলার সাহায্য ওর লাগবে। একাকী সব কিছু সামাল দেয়া ওর পক্ষে কোন অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। নোমান ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু রিমা তাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী জ্বালাতে চায় না। মানুষ জন নানা ধরনের কথা বলতে শুরু করবে, ইতিমধ্যেই যে বলছে না সেই নিশ্চয়তাও নেই। পিন্টুর সাথে তার মারপিটের কাহিনী ইতিমধ্যেই খবর কাগজে বিস্তারিত ছাপা হয়েছে। মিন্টুর মৃত্যুর পর, ভালো হোক আর মন্দ হোক, রিমা বহুল পরিচিতি পেয়েছে এবং অনেকেই তার ব্যাক্তিগত জীবন সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী। মানুষের কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই! আগে এই সব নিয়ে খুব মুষড়ে পড়ত, এখন প্ততাও দেয় না। কিন্তু তারপরও অকারণে গুজব ছড়াক সেটাও চায় না।

সকাল দশটার পর মিলার ফোন এলো। দোকানে না আসার জন্য ক্ষমা চাইল। বলল সে আয়েশার সাথে আছে। স্থানীয় একটা কমিউনিটি গ্রুপের সাথে মিটিং ছিল। ভাবেনি এতোক্ষণ লেগে যাবে। ফোন মিউট করে রেখেছিল। রিমা যে ফোন করেছে শোনেও নি। এখন তারা চলেছে আরেক বাসায়। সেখানে আরেকটা কমিউনিটী এডভাইসার গ্রæপের সাথে মিটিং আছে। আজ আর বিকালের আগে দোকানে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। খুবই ব্যাস্ত। রিমার কিছু প্রশ্ন ছিল কিন্তু উত্তর দেবার সময় মিলার নেই।

এক নম্বর প্রশ্ন, আয়েশাটা কে? তার কথা তো মিলা আগে কখন রিমাকে বলেনি। আর কমিউনিটি এডভাইজার গ্রুপই বা কি আর তাদের সাথে মিটিং করার পেছনে কারণটাই বা কি? যে মেয়েটা এবারের প্রভিন্সিয়াল এমপি ইলেকশনে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছে মিলা তার হয়েই এই সব কর্মকান্ডে জড়িয়েছে কিনা সেই ব্যাপারে ও নিশ্চিত নয়।

রিমা সাথে কাগজ, কলম এবং মাপার ফিতা নিয়ে এসেছিল। ওর আজকের পরিকল্পনা হচ্ছে কিছু মাপ-জোক নিয়ে দোকানের ভেতরটা কিভাবে সাজানো যায় সেটা নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করা। একজন সঙ্গী থাকলে ভালো হত। একাকী মাপ নেয়া একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। একদিকে টান লাগলে অন্য দিক নড়ে চড়ে যায়। অযথা সময় নষ্ট হয়।

নোমান এসে হাজির হবে আশা করেনি। দুপুরের দিকে যখন নোমান গাড়ি নিয়ে ওর দোকানের সামনের পার্কিং স্পটে এসে থামল এবং গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তখন রিমা যতখানি না আশ্চর্য হল তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হল। হাসি মুখে নোমানকে অভ্যর্থনা জানাল।
“তুমি এসেছ যে? অফিস নেই আজকে?”

“সেখান থেকেই তো আসছি,” নোমান তার স্বভাবজাত মিষ্টি এক টুকরো হাসি দিয়ে বলে। “সময়ের একটু আগেই লাঞ্চ ব্রেক নিয়ে নিয়েছি। মিলা বলেছিল তুমি এখানে থাকবে।”
“মিলার সাথে তোমার কবে পরিচয় হল?” রিমা সতর্ক কন্ঠে জানতে চায়। নোমানের সাথে মিলার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বলে ওর মনে পড়ে না।

“গতকালই পরিচয় হল,” নোমান বলল। “খানিকটা দুর্ঘটনাক্রমেই। আমার এক বন্ধু ডলিকে এবারের এমপি ইলেকশোনে এই ওয়ার্ড থেকে নমিনেশন পেতে সাহায্য করছে। স্থানীয় মানুষজনদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাবার চেষ্টা করছে সে। আমি গতকাল ওর সাথেই ছিলাম। সেখানে মিলাও ছিল।”

“তাই নাকি?” মিলা যে এই সবের সাথে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে গেছে জানা ছিল না রিমার।
“হ্যাঁ, আয়েশার সাথে এসেছিল। আয়েশা হচ্ছে ডলির স্কুলের বন্ধু। যাইহোক, মিলা তোমার কাছে আমার নাম শুনে থাকবে। এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি তোমাকে চিনি কিনা। বলল তোমার দুজন নাকি বেস্ট ফ্রেন্ড। সারাক্ষণ তোমার কথাই বলল। এবং প্রতিটা বাক্যে শুধু তোমারই স্তুতি – দারুণ! চমৎকার! অতুলনীয়!”

“ও খুব বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে,” রিমা হাসতে হাসতে বলল। “তা, কি নিয়ে কথা বললে তোমরা?” রিমা ইশারায় মাপার ফিতাটার একটা প্রান্ত নোমানকে ধরতে বলে অণ্য প্রান্তে যেতে ইংগিত করল।
“কার সাথে? ওহ, মিলার সাথে?”

“হুঁ,” রিমার চোখ ফিতার উপর থাকলেও মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। নোমানের মত সহজ সরল মানুষকে হস্তগত করতে মিলার খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। চিন্তাটা মাথায় আসতে নিজেকে একটু হিংসুটেই মনে হল। নোমান ছেলেমানুষ নয়।
“কথাবার্তা যা হল তার অধিকাংশই তোমাকে নিয়েই হল,” নোমান বলল। “তুমি যে তার বেস্ট ফ্রেন্ড সেটা জানতে আর কারো বাকী নেই। মিলাই বলেছিল আজ সকালে তোমার সাথে এখানে থাকবে। তোমাকে নাকি সাহায্য লাগবে।”
তবে কি মিলার জন্যই এসেছে নোমান? রিমা মনে মনে ভাবল। “ইলেকশনের কাজে আটকে গেছে ও। ডলির নমিনেশন সংক্রান্ত কিছু একটা হবে। পরে আসবে বলেছে। খুব একাকী লাগছিল এখানে। তুমি আসায় ভালোই হয়েছে।”
“আসতে পেরে আমি ধণ্য!” নোমান টেপের এক মাথা ধরে নির্দেশিত স্থানে যেতে যেতে বলল।

সত্যিই? ভাবল রিমা। মিলা যদি এখন এসে হাজির হয় তাহলে যা বোঝার বুঝে নেবে রিমা। মিলা কি তবে শেষ পর্যন্ত ওর নোমানের দিকেই নজর দিচ্ছে? ওর নোমান? হাস্যকর একটা চিন্তা! লোকটার ঘর ভেঙেছে। মিলার ভেঙেছে হৃদয়। দু’জনে দু’জনার জন্য ভালোই হবে। ফায়জা ঠিকই বলেছিল।
নোমান যখন একটা বাজার একটু পরে অফিসে ফিরে গেল এবং মিলা দুইটা বাজার বেশ কিছু পরে এসে হাজির হল এবং নোমান সম্বন্ধে কোন আলাপই করল না তখন মনে মনে বেশ লজ্জিত বোধ করলেও খানিকটা স্বস্তিও পেল রিমা।

মিলার মুখ থেকেই জানা গেল তার এতো ব্যাস্ততার কি কারণ। এন ডি পি থেকে নমিনেশন পাবার জন্য যদি অন্য কোন ক্যান্ডিডেট থাকে তাহলে ডলিকে প্রতিযোগীতার সম্মুখীন হতে হবে। প্রতিটা পার্টীর রেজিস্টার্ড মেম্বার আছে যারা নমিনেশনের সময় ভোট দেয়। মিলা আয়েশার সাথে একজোট পাকিয়ে কাজ করছে পার্টীতে ডলির প্রতি সহানুভূতিশীল নতুন মেম্বার সংযোজন করতে। আর কমিউনিটি এডভাইজাররা হচ্ছেন মূলত আঙ্কেল এবং আন্টিরা যারা এই এলাকায় বসবাস করেন এবং সাহঅ্যাের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মিলার সাথে আয়েশার পরিচয় হয় কোন এক বন্ধুর মাধ্যমে। আয়েশা তার কাছে সাহায্য চাইতে সে তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যায়। মিলার ব্যবহার সম্পূর্ণ পালটে গেছে এই কয়েক দিনেই। তাকে অনেক ধীর, স্থির, খুশী দেখাচ্ছে। কয়েক দিন আগেও দুঃখ-বেদনার যে আবরণ তাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল সেটা হঠাৎ করেই যেন উধাও হয়ে গেছে এবং তার স্থানে ফিরে এসেছে সেই পুরানো মিলা তার আনন্দময়, উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে। রিমা একাধারে খুশী এবং উচ্ছসিত হয়েছে। মিলা খুব চেষ্টা করল ওকেও দলে টানার কিন্তু রিমা আপাতত ঐ সবের সাথে জড়াতে চায় না। তবে কথা দিল ডলি যদি নমিনেশণ পেয়েই যায় তাহলে ও মিলার সাথে ক্যনভাস করবে।

৬৫
পিন্টু একদিন জেলে কাটিয়ে বাসায় ফেরার পর পাক্কা তিন দিন একমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া নিজের কামরা থেকে বেরই হল না। লাট্টু এবং নীতা সাধ্যমত চেষ্টা করলেন ওকে কোনভাবে বিরক্ত না করতে। পিন্টু এরেস্ট হবার পর থেকে লাট্টুই রেস্টুরেন্টটা সামলাচ্ছেন। নীতা ছেলের যাবতীয় পছন্দের খাবার রান্না করেছেন- নারকেলের দুধ দিয়ে গলদা চিংড়ী থেকে শুরু করে বেগুন ভাজি পর্যন্ত। পিন্টুর খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা নেই কিন্তু সে আলাপ করতে খুবই বিমুখ। নীতা আলাপ শুরু করার চেষ্টা করেছেন কয়েকবার কিন্তু তেমন সুবিধা না হওয়ায় সেই চেষ্টা বন্ধ করে দিয়েছেন। লাট্টু তাকে বলেছেন ধৈর্য্য ধরতে। তিনি ভেবেছিলেন মরিয়ম হয়ত খোঁজ খবর নেবে কিন্তু সেও একটা ফোন পর্যন্ত করেনি। পিন্টুর সাথে মরিয়মের কোন যোগাযোগ আছে কিনা নীতা জানেন না কিন্তু তার সন্দেহ আছে। তার একমাত্র জীবিত পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি খুবই ভাবিত হয়ে পড়েছেন। নিজের কামরায় সারাদিন দরজা বন্ধ করে কি করে সে? মদ খাচ্ছে? গাঁজা ভাং? ঐসব না করলেই ভালো। কারণ তাহলে তার এই সংসারটাকে আবার আগের পর্যায়ে নিয়ে যাবার সে সামান্য আশা তার এখনও আছে সেটুকুও উধাও হয়ে যাবে।

চতুর্থ দিনে পিন্টু নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে শেভ করল, স্যুট-প্যন্ট পরল, চুলে জেল লাগিয়ে ব্যাকব্রাশ করল। তাকে খুব সুদর্শণ এবং তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছে। নীতা মুখের হাসি চেপে রাখতে পারলেন না।
“বাবা, তোকে তো খুব সুন্দর লাগেছে! কোথায় চললি?” জিজ্ঞেস করলেন। পিন্টুর এই জাতীয় পরিবর্তনের কারণটা ধরতে কষ্ট হচ্ছে তার।
পিন্টূ মাকে জড়িয়ে ধরল। “আমি সব সমস্যা মিটিয়ে দেব, মা।”

নীতা ছেলের মনের রহস্য আরেকটু খোলাসা করানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। পিন্টু আর কিছু বলল না। বাইরে বের হবার সময় সবচেয়ে ভালো জুতা জোড়া পরল, মাকে বিদায় জানিয়ে পর্শাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। নীতা স্বামীকে ফোন দিয়ে এই নতুন সংবাদটা জানালেন। লাট্টু তাকে বললেন নীরনে অপেক্ষা করতে। ভালো কিছু একটা হবে বলে মনে হচ্ছে।

পিন্টু বিশাল একটা ফুলের তোড়া কিনে পর্শা চালিয়ে ড্যানফোর্থে সোজা আবুলের বাসায় গিয়ে হাজির হল। সময়টা দুপুরের কাছাকাছি, বাচ্চাদের স্কুলে থাকার কথা। তার আশা ছিল মরিয়ম দোলনের সাথে বাসায় থাকবে। গিয়ে দেখল বাসায় দু’জনার কেউ নেই। মরিয়মকে অবাক করে দেবে ভেবেছিল, সেটা চুলায় গেল। মনে মনে হতাশ হলেও পিছিয়ে যাবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিল পিন্টু। কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর মরিয়মকে ফোন করাই সাব্যস্ত করল। সে তার ফোন আদৌ ধরবে কিনা কে জানে। “হ্যালো?” মরিয়মের কন্ঠ বিহ্বল শোনাল। পিন্টুর ফোন আশা করেনি সে।
মরিয়ম তার ফোন ধারায় পিন্টূ মনে মনে খুব খুশী হয়ে গেল।
“মরিয়ম!” পিন্টু তার কন্ঠের স্বভাবজাত কর্কশতা দূর করে যতখানি সম্ভব নমনীয় করে বলল।
“হ্যাঁ?”
“তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম,” পিন্টু অপরাধী কন্ঠে বলে।
“কোথায় তুমি? ভাইয়ার ওখানে?” মরিয়মের কন্ঠ শুনে মনে হল না সে রেগে আছে।
“হ্যাঁ। ভেবেছিলাম হয়ত বাসায় থাকবে।”

মরিয়ম কয়েক মুহুর্তের জন্য নীরব থাকল। “আসার আগে ফোন দেওয়া উচিৎ ছিল। আমরা কাছেই একটা বাসায় এসেছি, দুই মিনিটের ড্রাইভ।”
মরিয়ম তাকে চলে যেতে বলেনি। পিন্টু আশান্বিত হয়ে উঠল। “আমি আসব ওখানে?”
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। “কিছু লাগবে তোমার?”
পিন্টু গলা পরিষ্কার করল। “তুমি যদি চাও তাহলে কোথাও গিয়ে একসাথে লাঞ্চ করা যায়।”
লাইনের অন্য প্রান্ত থেকে মরিয়মের অস্ফুস্ট কন্ঠ শোনা গেল, “লাঞ্চ!”
“তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে,” পিন্টু বিড়বিড়িয়ে বলে।
নীরবতা। পেছনে দোলনের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। মরিয়ম নীচু গলায় তাকে কিছু বলল। “আমার সাথে দোলন আছে,” মরিয়ম বলল।
“ও আচ্ছা!” পিন্টু কি বলবে বুঝতে পারে না। দোলন ওদের সাথে গেলে মরিয়মকে যা যা বলবে বলে ভেবে এসেছে সেসব কিছুই বলা যাবে না। দোলনের সামনে সেই সব প্রসঙ্গ তোলাটা খুব অপমানজনক হয়ে যাবে।
“ওখানেই থাক। আমি দোলনকে নিয়ে বাসায় আসছি,” মরিয়ম বলল। “পাঁচ মিনিট।”