শুজা রশীদ : (পর্ব ৩৩)
রনক বোনের চীৎকার শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমবারের মত রিমার দিকে তাকিয়েছিল। “মিথ্যে বলছি না আপু, সবাই তোমাকে খারাপ মেয়ে বলে। আমাদের পাড়ায়, আশে পাশের এলাকায়, যেখানেই যাই সেখানেই এই সব শুনতে হয়। ও তোমার জীবনটা নষ্ট করেছে। অনেক আগেই ওকে শেষ করে দেয়া উচিৎ ছিল আমার। তোমাকে বাঁচানোর সেটাই ছিল একমাত্র উপায়।”

চার বছর পেরিয়ে গিয়েছিল শেষবার যখন ভাইকে দেখেছিল রিমা। সে ছিল এক লাজুক কিশোর যার হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু ছিল। তার মানশ্চক্ষে ভাইয়ের যে ছবি আঁকা ছিল এই রনকের সাথে তার কোন সামঞ্জস্যই ছিল না। নিজের জীবন যুদ্ধে রিমা এতই মগ্ন হয়ে ছিল যে ভুলেই গিয়েছিল বয়সন্ধিক্ষণে অধিকাংশ গন্তব্যহীন কিশোররা যে ভ্রান্তিময় পথে পাড়ি জমায় তার ভাইও সেই মোহময় হাতছানির কবলে পড়ে বিপথগামী হতে পারে। তার সামনে যে তরুণটি দাঁড়িয়ে ছিল, যাকে সে তার হৃদয়ে অনেক উঁচু আসনে বসিয়ে রেখেছিল, তার দৃষ্টির রুঢ়তা, কন্ঠের উগ্রতা এবং ভাষার অশোভনতা মুহুর্তের মধ্যে সেই ভাবমূর্তিকে চূর্ণ বিচুর্ণ করে দেয়। সে বাকহারা হয়ে গিয়েছিল। কি বলবে ভেবে পায়নি। অবশ্য তার কথা শুনবার সময় কিংবা ধৈর্যও রনকের ছিল না। সে কিছু শুনতে কিংবা বুঝতে আসেনি। সে এসেছিল এক কুবুদ্ধি নিয়ে।

রিমা কিছু বলার কিংবা করার আগেই রনক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নোমানের উপর, তার হাতের লোহার রড অসম্ভব আক্রোশে নোমানের শরীরে এঁকে দিচ্ছিল কঠিন ধাতব নির্মমতার চিত্র, ছোপ ছোপ রক্তে রেঙে যাচ্ছিল তার পরণের কাপড়, ব্যাথায় যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছিল সে ক্ষণে ক্ষণে। রনকের দুই সহকারী পাশেই দাঁড়িয়েছিল, প্রস্তুত ছিল কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এলে তাকে রুখে দেবার জন্য। প্রাথমিক হতবিহবলতা কাটতে রিমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বিদ্যুতের মত। আচমকা এক মহাশক্তি যেন তার শরীরে ভর করেছিল। এক দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে সে স্থাপন করেছিল রনক এবং নোমানের মাঝে। রক্তাক্ত, বিধস্ত, কিন্তু তারপরও পরাস্তহয়নি নোমান। এক দৃঢ় প্রাচীরের মত সে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রস্তুত ছিল যে কোন আক্রমণকে বিশোষণ করতে।

এক ভয়াবহ ক্রোধে ফুঁসছিল রনক। হাতের এক ঝাপটায় রিমাকে সামনে থেকে সরিয়ে দেয় সে, তারপর প্রবল বেগে হাতের রড চালায় নোমানের মাথা লক্ষ্য করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই আঘাতটা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য মাথাটাকে যথা সম্ভব পেছনে হেলিয়ে দিয়েছিল নোমান, কিন্তু তারপর শেষ রক্ষা হয়নি। তার কপালে এসে আছড়ে পড়ে লোহার রড, চামড়া ভেদ করে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে উষ্ণ রক্তের প্রবাহ, দ্রæত আবৃত করে দেয় নোমানের সর্বাঙ্গ। সেই রক্তাক্ত অবয়বটার দিকে তাকিয়ে রিমার মনে হয়েছিল সে মুর্ছা যাবে।

এই পর্যায়ে রনকের দুই সহকারী ঘাবড়ে গিয়েছিল। ঘটনা এতদূর গড়াবে তারা বোধহয় ধারনা করেনি। “চল, ভাগি!” তাদের একজন বলে ওঠে। “এই, লোকটাকে মেরে ফেলবি নাকি?”
রিমার ভয় হচ্ছিল রনক যদি আবার আঘাত করে তাহলে নোমানের সেখানেই ইতি হতে পারে। এক হাতে নিজের কপালের ক্ষতটা চেপে ধরে অবশ ভঙ্গিতে মাটিতে এলিয়ে পড়েছিল নোমান।
“রনক, ওর গায়ে আর হাত দিবি না!” রিমা অসম্ভব জোরে চীৎকার করে উঠেছিল। “তোকে আমি ঘেন্না করি। আমার সারা জীবনে আমি কাউকে এতো ঘৃণা করিনি। যা, ভাগ এখান থেকে। তোর মুখ আমি আর কোন দিন দেখতে চাই না!”

রনকের দৃষ্টি দেখে মনে হয়েছিল তার ভেতরে যেন এক ভিন্ন কোন শক্তি ভর করেছিল। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল নোমানের উপর, রাগে-ক্রোধে জ্বলছিল দুই চোখ, সংকুচিত প্রসারিত হচ্ছিল তার নাকের গহ্বর, শেষ আঘাত হানবার জন্য মাথার উপর তুলেছিল সে লোহার রড। রিমারবুঝতে বাকী থাকে নি কি করতে চলেছে রনক। এগিয়ে গিয়ে দুই হাতে চেপে ধরেছিল সেই রডের খোলা প্রান্ত, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে ধরে রেখেছিল, ভারসাম্য হারিয়ে একসময় মাটিতে পড়ে গেলেও কোন অবস্থাতেই সেই রড সে ছাড়েনি। রনক ঝাঁকি দিয়ে তার হাত থেকে রডটাকে মুক্ত করতে চেয়েছিল কিন্তু সক্ষম হয়নি, রিমার শক্তি দেখে সে স্পষ্টতই বিস্মিত হয়েছিল।
“চল যাই,” রনকের সঙ্গী দু জন তাড়া দেয়।

রিমার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে ছিল রনক, তারপর ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়েছিল হাতের রড। ঘুরে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে হেঁটে বাসার সীমানার বাইরে চলে যায় সে। এক দুঃস্বপ্নের মত যে ঘটনার শুরু হয়েছিল মাত্র মিনিট দুয়েকের ব্যবধানেই তার সমাপ্তি হয়।
রিমা ছুটে গিয়েছিল নোমানের কাছে। সে চিত হয়ে শুয়ে ছিল মাটিতে, তার দুই চোখ খোলা ছিল কিন্তু সে কিছু দেখছিল বলে মনে হয়নি। তার ক্ষত থেকে তখনও রক্তের স্রোত গড়িয়ে নামছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুই হাতে সেই ক্ষত চেপে ধরে বসে ছিল রিমা, থামিয়ে দিতে চেয়েছিল রক্ত ক্ষরণ।
“ড্রাইভার সাহেব, আমাকে একটু সাহায্য করেন,” চীৎকার করে ডেকেছিল সে। “ওকে এক্ষুণি ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে।” কাছেই একটা প্রাইভেট ক্লিনিক ছিল। সেখানে যত দ্রæত নেয়া যাবে নোমানের বেঁচে যাবার সম্ভাবনা ততই বেশি হবে।

বাসার কাজের মহিলার সাহায্যে নোমানের কপালের ক্ষতে একটা ব্যন্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল রিমা, তারপর ড্রাইভারের সাথে তাকে ধরে গাড়ীতে তুলেছিল। বাচ্চাদেরকে কাজের মহিলার কাছে রেখে নোমানকে নিয়ে ছুটেছিল ক্লিনিকে, তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল নোমান, তার ব্যাণ্ডেজের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে নামা রক্তের ধারায় রেঙে গিয়েছিল রিমার সবুজ শাড়ী।
বেঁচে গিয়েছিল নোমান। এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল ক্লিনিকে। কনকাশন হয়েছিল তার, কপালের ক্ষতটাতে লেগেছিল পঞ্চাশটার মত স্টিচ, কিন্তু সৌভাগ্যবশত তার জীবন রক্ষা হয়েছিল। রিমা পুলিশে কেস করতে দৃঢ় সংকল্প ছিল কিন্তু নোমান বাঁধা দিয়েছিল। রনকের সামনে পড়ে ছিল সারাটা জীবন। রাগের মাথায় না বুঝে সে একটা ভুল করেছিল, সেই জন্য তার জীবনটাকে নষ্ট করতে চায় নি নোমান।

প্রথম প্রথম তার কপালের বিশাল ক্ষতচিহ্নটাকে দেখে ভয়াবহ মনে হত কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেটা যেন নোমানের শরীরের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। নোমান নিজে কখন সেটা নিয়ে কোন অনুযোগ করেনি বরং ঠাট্টা করে তার নাম দিয়েছিল প্রেম রেখা।
সেই ঘটনার পর রিমা বুঝেছিল তার পরিবারের সাথে পূনর্মিলনের আর কোন সম্ভাবনা তার ছিল না। তখনই তার মাথায় আসে পলায়নের চিন্তা। তার এবং তার সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তাই তার কাছে হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

৪৭
জাফর আলী মাঝারী আকৃতির ভদ্র দর্শন মানুষ, তার মাথা ভর্তি কালো চুল এবং মুখে কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। বয়েস চল্লিশের কিছু বেশী হবে। তার সাথে রিমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে ড্রাইভিং ইন্সট্রাকটর আসমা। সে রিয়েল স্টেট এজেন্ট। আসমা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সে খুবই বিশ্বাসযোগ্য এবং কখন কমিশনের লোভে কাউকে জোরাজুরি করে বাড়ী কেনায় না। আসমার অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক মানুষই এখন রিয়েল স্টেট এজেন্ট হয়েছে কিন্তু সবার উপরে সমানভাবে আস্থা রাখা যায় না। রিমার মনে হয়েছে এখনই বাড়ি খুঁজতে শুরু করাটা গাছে কাঠাল গোঁফে তেলের মত অবস্থা, কিন্তু আসমা তাকে বুঝিয়েছে বাড়ি কিনতে হলে একটু আগেভাগে মাঠে নামাই বুদ্ধির লক্ষণ।

ভালোর মধ্যে এই যে, গত কয়েক বছর ধরে উন্মাদের মত মূল্য বৃদ্ধির পর টরন্টোর রিয়েল স্টেট মার্কেট ইদানীং একটু শীতল হয়েছে। কয় দিন আগেও মানুষজন নীলাম ডেকে বাড়ি কিনছিল, বাড়িওয়ালারা যা দাম তার চেয়ে অনেক বেশী দাম হাঁকছিল। কিন্তু বাজারে বাড়ীর দাম এখন কমে ভদ্র পর্যায়ে আসার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য সুবিধা হয়েছে। আসমার মতে বাড়ি কেনার এখনই যথার্থ সময়। আবার কখন হঠাৎ করে পাগলা ঘোড়া মাতাল বেগে ছুট দিতে শুরু করবে কে বলতে পারে? টাকা নিয়ে ভাবনার কি আছে? রিমা তো ইন্সুরেন্সের টাকাটা কোন একসময় পাবেই। হয়ত মাস দুই লাগবে। কোন বাড়ি পছন্দ হলে অফার দেবার সময় একটা শর্ত জুড়ে দিলেই হবে। যদি প্রয়োজন হয় সেকিঊরিটি ডিপোজিটের টাকাটা আসমাই তাকে ধার দিতে পারবে।

নভেম্বরের এক শীতল সকালে রিমা এবং ফায়জা জাফর আলীর সাথে বিখ্যাত ঝঅঞঊঈ স্কুলের নিকটে একটা বাড়ি দেখতে এলো। এই এলাকার মাধাবী ছাত্র ছাত্রীরা সবাই এই স্কুলে যাবার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী। ড্যানফোর্থ এভেনিউয়ের বেশ কাছাকাছি অবস্থিত হলেও এলাকাটা বেশ চুপচাপ, বাংলা পাড়ার হৈ হল্লা এখানে একেবারেই নেই। কিন্তু ওদের কাছে স্কুলটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফায়জা পণ করেছে এই স্কুলে তাকে যেতেই হবে।
বাড়িটা পুরানো, চিকন লম্বা প্লটের পেছন ঘেঁষে অবস্থিত। সামনে বিশাল আঙিনা, যতœ আত্তিরঅভাবে চারদিকে জংলা হয়ে গেছে। ডানে, বায়ে এবং পেছনের সীমানা ফুট ছয়েক উঁচু কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা, যার নানা স্থানে ঘুণ ধরেছে, রাজ্যের লতানো আগছার ভারে কোথাও কোথাও নুয়ে পড়েছে। ড্রাইভওয়েটাও ঠিকঠাক করাতে হবে, কতক জায়গা থেকে এসফল্ট চাং বেঁধে উঠে এসেছে। কোন পৃথক গ্যারাজ নেই। বাড়ীর মালিকের বয়েস সত্তরের মত। সে চিরকুমার, একাকী থাকে। এই বাড়িটা বেঁচে তার ইচ্ছে নোভাস্কোশিয়াতে তার আত্মীয় স্বজনদের কাছে চলে যাবার কিন্তু তার তেমন কোন তাড়া নেই। যার অর্থ, রিমার যদি বাড়িটা পছন্দ হয় এবং ও একটা ভালো অফার দেয় তাহলে বাড়িওয়ালা হয়ত মাস দুই তিন অপেক্ষা করতে রাজী হয়ে যাবে। অন্তত সেটাই তাকে বুঝিয়েছে জাফর আলী। রিমার অবশ্য বাইরে থেকে দেখে বাড়ি বিশেষ পছন্দ হয়নি। এইরকম একটা বাড়িতে এসে উঠবার ওর কোন আগ্রহ নেই। এটাকে ভদ্র দর্শণ করতে হলে প্রচুর কাজ কর্ম করাতে হবে।
জাফরের অনুরোধে বাড়ির মালিক কিছুক্ষনের জন্য বাইরে গেছে ওদেরকে বাসার ভেতরটা নিরালায় দেখার সুযোগ করে দেবার জন্য। সম্ভাব্য ক্রেতার জন্য এটা নাকি অবশ্য করনীয় –জাফর জানিয়েছে। তাতে বাড়িটাকে নিজের মত করে কল্পনা করবার সুযোগ তৈরী হয়। রিমা এবং ফায়জা চোখাচোখি করে। বাড়ির বাইরেটা দেখেই তাদের বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে। তাদের বর্তমান এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে অনেক দোষ ত্রæটি থাকলেও তার অবস্থাও এর চেয়ে যথেষ্টভালো।

জাফর সদর দরজার তালা খুলে ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে আমন্ত্রণ জানাল। ভেতরে পা দিয়েই এয়ার ফ্রেসনারের তীব্র লেবুর গন্ধ ওদের নাকে ঝাপটা দিয়ে গেল। ওদেরকে নাক কুঁচকাতে দেখে জাফর লজ্জিত কন্ঠে বলল, “একটু বেশি দিয়ে ফেলেছি। অনেক দুর্গন্ধ হয়ে ছিল। বাড়িওয়ালা বয়েসী মানুষ। বাসার দেখভাল করতে পারে না।”

দেখেই বোঝা গেল জাফর তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে বাসাটাকে পরিষ্কার পরিছন্ন করে, আসবাবপত্র সরিয়ে খানিকটা দর্শণযোগ্য করতে। মোটের উপর বাড়িটা একটু ছোটই। বাংলো স্টাইলের তিন বেডরুমের বাসা, নীচে হাফ বেসমেন্ট, সেখানে খান দুই কামরা এবং একটা বড়সড় স্টোর রুম যেখানে রাজ্যের জিনিষপত্র গুদাম করে রাখা- পুরানো আসবাবপত্র থেকে শুরু করে শত শত গল্পের বই, পুরানো জামা কাপড় ইত্যাদি। অতীতে কোন এক সময়ে নীচের তলার কামরা দুটা ভাড়া দিত বৃদ্ধ কিন্তু ভাড়া নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হবার পর সে ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দেয়। রিমা চাইলে কামরা দুটা ভাড়া দিয়ে কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের ব্যবস্থা করতে পারবে। দেশী বাড়িওলাদের কছে এটা খুবই জনপ্রিয়। রিমা এবং ফায়জা দুজনার কারোরই ভাড়া দেবার ব্যাপারেকোন আগ্রহ নেই। কে না কে এসে থাকবে। অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য কোন ঝুঁকি নিতে চায় না ওরা।

মেইন ফ্লোরের বেডরুমগুলো বেশ ছোটই। যে কামরাটাকে মাস্টার বেডরুম বলে চালানো হচ্ছে সেটা কিঞ্চিৎ বড়, সাথে এনসুইট আছে। রান্নাঘরে চারদিকে ময়লা চিটচিট করছে। কাঠের মেঝেটাও নানা স্থানে নড়বড়ে হয়ে গেছে, রঙ চটে গেছে। তবে বাসাটার প্রশস্ত লিভিং কাম ডাইনিং রুমটা ওদের খুবই পছন্দ হল।সামনে বিশাল জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ায়স্থানটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।
“কেমন লাগল বাড়িটা?” চারদিকে ঘুরিয়ে দেখানোর পর জানতে চাইল জাফর।
রিমা এবং ফায়জা আবার চোখাচোখি করে। বাড়িটার কিছু কিছু ভালো দিক থাকলেও সব মিলিয়ে ভালো লাগেনি। মনে হয়েছে বেশী পুরানো, কেমন গুমোট।
“খুব একটা খারাপ না,” রিমা ইতস্তত করে বলে। মন্দ কিছু বলে ভদ্রলোকের মনটা খারাপ করে দিতে চায় না।

“আমি জানি, বেশ কিছু কাজকর্ম করাতে হবে,” জাফর সহজ কন্ঠে বলে। “বাড়িওয়ালার নাম মিস্টার এন্ড্রু। তার আছে আর্থারাইটিস। হাঁটা চলা করতেও অসুবিধা। যে কারণে বাসার এই অবস্থা। কিন্তু সে মানুষ ভালো। বহু বছর আগে SATEC এর শিক্ষক ছিল।”
এই কথা শুনবার পর ফায়জার আগ্রহ একটু বাড়ল। “তাই নাকি? কি পড়াত?”
“অংক, যতদূর মনে পড়ে,” জাফর বলে। ফায়জাকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করে এবার। “তোমাকে দেখে আরেকটা মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। আমার এক পারিবারিক বন্ধুর মেয়ে। বাবা-মায়ের সাথে কানাডা এসেছিল যখন তার বয়েস খানিকটা তোমার মতই ছিল। এদিকেই কোন একটা বাসাতে ভাড়া থাকত তারা।”

ফায়জা একটু বিস্মিত হয়, ভদ্রলোক হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন তুলল সে বুঝতে পারে না।
“মেয়েটার নাম ডলি বেগম,” জাফর মুচকি হেসে বলে। “পরবর্তি প্রভিন্সিয়াল ইলেশনে ঘউচর প্লাটফর্মে গচচহিসাবে ভোটে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছে সে। মেয়েটা যেমন স্মার্ট তেমন আলাপী। তোমাকে দেখেও আমার খুব স্মার্ট মনে হচ্ছে। হয়ত বড় হলে তুমিও আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে।”
ফায়জা তাকে ধন্যবাদ জানায়। ডলি বেগমের কথা সে আগে কখন শোনেনি। “সে কি SATEC এপড়াশোনা করেছে?”
“আমার যতদূর মনে পড়ে,” জাফর বলে।
ফায়জা রিমার সেল ফোনটা নিয়ে গুগলে সার্চ করে। “সে কি নমিনেশন পাবে মনে হয়?”
জাফর মাথা দোলায়। “পাবার খুব ভালো সম্ভাবনা আছে।”
“ভালোই হবে!” ফায়জা বলে। “আজ পর্যন্ত কানাডায় বাংলাদেশী কেউ গচহিসাবে নির্বাচিত হয় নি।”
“ঠিকই বলেছ,” জাফর বলে। “তোমার কিসে আগ্রহ, ফায়জা?”
ফায়জা কাঁধ ঝাঁকায়। “জানি না। শিক্ষক হতে পারি। হাই স্কুলের। সায়েন্স খুব ভালো লাগে আমার।”

“তাই নাকি!” জাফর খুশি হয়ে যায়। “দেশে থাকতে আমি ছিলাম কৃষি বিজ্ঞানী। এখানে এসে রিয়েল স্টেট এজেন্ট হয়ে বাড়ি বিক্রী করছি। কোন অভিযোগ নেই কিন্তু যদি সম্ভব হত তাহলে আবার বৈজ্ঞানিক কাজের সাথে জড়িত হয়ে যেতাম। আমার ছেলে মনে হচ্ছে ঐ দিকেই যাবে। বায়ো কেমিস্ট্রিতে চয.উ.করছে সে।”

তাদেরকে এলাকাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাল জাফর। রিমা এই এলাকায় আরোও কিছু বাসা দেখবার আগ্রহ দেখাল। ঝট করে একটা কিছু কিনতে চায় না ও। তার হাতে সময় আছে। জাফর তাকে নিশ্চিত করল সে আরোও কিছু বাসা তাকে দেখাবে, শীঘ্রই।