শুজা রশীদ : (পর্ব ৩২)
৪৫.
দেলোয়ার সফল ব্যবসায়ী হলেও তার প্রচুর দায়বদ্ধতা ছিল। দেশের ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে সে ছিল প্রথম সারির একজন, বেশ কিছু বেআইনি ব্যবসার সাথে সে জড়িত ছিল, ঘুষ দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়াটা তার কাছে ছিল একটা শিল্পের মত- সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে পুলিশ, ব্যঙ্ক কর্মচারী, সাধারণ মানুষ জন সবাইকেই সে ছলে বলে কৌশলে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসত। আরেকটা বড় দোষ ছিল তার- তরুণী, সুন্দরী মেয়েদের প্রতি অসম্ভব আকর্ষণ। আইন তাকে ছুঁতে পারত না তার কারণ দেশের ক্ষমতাশালী মানুষদের সাথে তার ছিল দহরম মহরম, পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে ছিল গলায় গলায় ভাব। সে তাদেরকে খুশী রাখত, তারা তাকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করত।
দেলোয়ারের সাথে বিয়ে হবার পর রিমাকে কাজ ছেড়ে দিতে হল। তার স্থানে যে তরুণী মেয়েটি এসেছিল সাময়িকভাবে তার শখ ছিল অভিনেত্রী হবার। তার নাম ছিল পপি। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ছিল সে, একাউন্টীংয়ে ডিগ্রী ছিল, ভবিষ্যতে অভিনয়ের পাশাপাশি কোন একটা প্রাইভেট ফার্মে একজেকিউটিভ হিসাবে কাজ করবার ইচ্ছা ছিল তার। মেয়েটির আরেকটি পরিচয় ছিল। সে ছিল দেশের এক ক্ষমতাশালি মন্ত্রীর একমাত্র ভাতিজী। মন্ত্রীর সমর্থক গোষ্ঠী ছিল বিশাল, তাদের কারো কারো অপরাধচক্রের সাথে ছিল ঘনিষ্ট যোগাযোগ। দেলোয়ারের সাথে মন্ত্রীর বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। মন্ত্রী তার ভাতিজীকে পাঠিয়েছিলো দেলোয়ারের কম্পানিতে কিছুদিন তার খুব কাছাকাছি থেকে কাজ কর্ম করে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। দেলোয়ারকে কথাটা বলতেই এক বাক্যে রাজী হয়ে গিয়েছিল সে।
কিন্তু দাবার ছক গেল পালটে। আগে দেলোয়ার ধীরে সুস্থে, হিসেব করে নিজের বিত্ত-বৈভব এবং ক্ষমতার প্রাচুর্য দেখিয়ে জয় করে নিত তার পছন্দের তরুণীর হৃদয়। এবার হল ঠিক তার উল্টো। সে বিবাহিত জেনেও পপি তার পিছু নিল। পপি দেলোয়ারের অন্য অফিস এডমিনদের মত ছিল না। সে ছিল ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করা শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ধনবান ঘরের মেয়ে, পশ্চিমা সংস্কৃতির বাহক এবং ধারক, জীবনে সাফল্য অর্জনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে আর কিছু ছিল না। দেলোয়ারকে বশে আনতে তার তেমন কোন বেগই পেতে হয়নি। পপি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার সৌন্দর্য, যৌবন, এবং তারুণ্যের ঝড়ো বাতাসে। তার পিছু পিছু দেলোয়ার ছোটে পার্টি থেকে পার্টিতে, মদ, নেশা আর যৌনতায় মত্ত হয়ে ওঠে। খুব শীঘ্রই নিজের ভুল বুঝতে পারে সে যখন তার গোচরে আসে পপির সাথে তার নানা ভঙ্গীর যৌন ক্রীড়ার ছবি এবং ভিডিও যেগুলো প্রকাশিত হলে ফলাফল তার মত একজন বিবাহিত মানুষের জন্য কোন অবস্থাতেই ভালো হতে পারে না।
রিমা যখন তার প্রথম বাচ্চা প্রসব করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ততদিনে পপি দেলোয়রকে তার ষড়যন্ত্রের জালে সম্পুর্ণ জড়িয়ে ফেলেছে এবং তাকে রিমার কাছ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছে। পপির উদ্দ্যেশ প্রথম থেকেই ছিল রিমাকে দেলোয়ারের জীবন থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়া এবং দেলোয়ারকে বিয়ে করে তার সহায় সম্পত্তি এবং বহু কম্পনীর মালিকানা ধীরে ধীরে কুক্ষিগত করা। তার পেছনে ছিল ক্ষমতাবান মানুষেরা। ভয় পাবার তার কোন কারণ ছিল না। পপির প্রথম উদ্দ্যেশ্য ছিল রিমাকে গুলশানের আলিশান বাড়ী থেকে সরিয়ে ফেলা। সেই পর্যায়ে দেলোয়ারের ব্যক্তিগত ইচ্ছার আর তেমন কোন মূল্য ছিল না বলেই রিমার ধারনা। পপি তাকে বø্যাকমেইল করছিল আর তার মন্ত্রী চাচা ক্রমাগত চাপের সৃষ্টি করছিল।
“ফায়জার বয়েস তখন বছর খানেক, এক রাতে আগে থেকে খবর না দিয়ে দেলোয়ার হঠাৎ ধানমন্ডির বাসায় আমার সাথে দেখা করতে এলো,” রিমা নীচু স্বরে কথা বলে, নিশ্চিত হতে চায় বাচ্চারা যেন তার কথা শুনতে না পায়, বিশেষ করে ফায়জা। এখনও সব কিছু বিস্তারিত জানার মত বয়েস তাদের হয়নি, এমনকি ফায়জার নয়। “আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। সারা সপ্তাহ তার সিঙ্গাপুরে থাকার কথা ছিল। হঠাৎ ঢাকায় কেন? সেই রাতে আমাকে সব খুলে বলেছিল সে। আমাকে লোকটা ভালবাসত, তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ছিল, বলেছিল আমাদের বিয়েটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। পপি তাকে চাপাচাপি করছিল আমাকে ডীভোর্স দিয়ে বছর খানেকের মধ্যে তাকে বিয়ে করবার জন্য। আমি অনেক কেঁদেছিলাম। তাকে বলেছিলাম আমার যাবার আর কোন জায়গা নেই। সে আমাকে নিশ্চিত করেছিল আমার ভরণ পোষনের ব্যবস্থা সে করবে। আমার ভয় পাবার কোন কারণ নেই। বিশ্বাস কর আর না কর সেই রাতে জিব্রান এলো আমার পেটে। একেই বলে গর্দভ!”
নোমান নীরবে শুনছিল। তার মনে যদি কোন প্রশ্ন থেকেও থাকে সে জিজ্ঞেস করে না।
“ওর জীবনটাকে আরও জটিল করে দিতে চাইনি আমি,” রিমা বলে। “তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম সেটা সত্য নয়, বরং বলা যায় আমার চোখে ধাঁধাঁ লেগে গিয়েছিল। আমি একরকম সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। কি করছিলাম ঠিক মত বুঝিওনি। তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার ব্যাপারটা যে জন্য খুব একটা কষ্টকর মনে হয়নি। তার প্রতি আমার যেটুকু অনুরাগ ছিল তা ততদিনে প্রায় উধাও হয়ে গেছে। আমার তখন একমাত্র চিন্তা ছিল ফায়জার ভবিষ্যৎ নিয়ে। সে আমাকে কথা দিয়েছিল ফায়জার কখন কোন অসুবিধা হবে না। আমি ধানমন্ডির ঐ একই বাসায় থাকতে পারব কিংবা চাইলে আরেকটু ভালো বাসাতে যেতে পারব। আমার গাড়ী এবং কাজের মানুষ তো থাকবেই সাথে একটা মোটা অংকের মাসিক ভাতাও আমি পাবো তার কাছ থেকে। সে উকিল দিয়ে আইন সঙ্গত ভাবে সব কিছু করবে।”
নোমান অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ে। “এই ব্যাপারটা আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন বোধ করনি!”
“জানাতে চেয়েছিলাম,” রিমা অপরাধী মুখে বলে। “কিন্তু ঐ ঘটনাটার পর,” নোমানের মুখের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্নটার দিকে নির্দেষ করে ও, “তোমাকে আর নতুন করে কোন বিপদের মধ্যে আমি ফেলতে চাই নি। আমার জন্য ততদিনে অনেক যন্ত্রণা তুমি সয়েছ। আর কত?”
নোমান নিজের মুখের ক্ষত দাগটাতে হাত বোলায়। “এটা কিছু হল? যাইহোক, তার পর কি হয়েছিল বল।”
রিমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “মাস খানেক পর আমার প্রেগনেন্সী টেস্ট পজিটিভ এলো। তখনই আমার মত পালটে যায়। একটা বাচ্চা না হয় আমি কোন রকমে একাকী সামাল দিতে পারব কিন্তু দুই জন? আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার মত অবস্থা হয়েছিল। দেলোয়ারকে জানালাম এখনই ডিভোর্সে আমি যেতে চাই না, দ্বিতীয় বাচ্চাটা না হওয়া পর্যন্ত তো নয়ই। শুনে খুব একটা খুশী না হলেও মেনে নিয়েছিল। পপি ভীষণ চাপ দিচ্ছিল, আমাকে না ছাড়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না। আমার মতামত থাকলেও না। সেটাই ছিল তার শর্ত।”
রিমা হঠাৎই যেন ফিরে যায় অতীতে, সেই মুহুর্তে। কি সময়টা না গেছে! জিব্রানের জন্মের পর ডিভোর্সের ব্যাপারে আরোও বেঁকে বসে রিমা। বাচ্চাদেরকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দিতে তার মন সায় দেয় না। দেলোয়ারের কথার কতটুকু মূল্য আছে তাতে তার সন্দেহ ছিল। বাড়ি, গাড়ি এবং মাসোহারার যে প্রতিশ্রæতি সে দিয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে কিনা তার নিশ্চয়তা কোথায়? আইন সঙ্গতভাবে করলেই পরবর্তিতে সে যে অন্য কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে সেই প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করবে না তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়?
তারপর একদিন একজন অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে একটা ফোন কল এলো। লোকটা খুব সংক্ষেপে বলল, দেলোয়ারের জীবন থেকে রিমার চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। না গেলে পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে মোড় নেবে।
“তোমাকে ভয় দেখিয়েছিল ওরা!” নোমান শুষ্ক মুখে বলে।
“আমাকে তিন মাস সময় দেয়া হয়েছিল। তারপর যে কোন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। সেই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিনি আমি। তোমাকে না, দেলোয়ারকে না। ভেবেছিলাম তাতে পরিস্থিতি আরোও খারাপই হবে। পুলিশের কাছে গিয়েও কোন লাভ হত না। তারা সরকারী পার্টির ক্ষমতাশালী মানুষদের হাতের পুতুল। আমি শুধু ভাবছিলাম কিভাবে এই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি থেকে চিরতরে পালিয়ে যাওয়া যায়। দেলোয়ারকে বললাম আমাদেরকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। কারও জানার দরকার নেই আমাদের অবস্থান। গোপনে আমরা বিবাহিতই থেকে যাবো। দেলোয়ার রাজী হল না। আমাকে উল্টো ভয় দেখাল আমার যদি দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার কোন পরিকল্পনা থাকে তাহলে আমার বাচ্চাদের সে নিয়ে নেবে। সেটা আমি কোন অবস্থাতেই হতে দিতে পারতাম না। তারপর আমি যা করলাম সেটাকে অচিন্তনীয় বলতে পারো।”
আজও সে কথা মনে হলে রিমার শরীর কেঁপে ওঠে। কোথা থেকে সেই সাহস তার হয়েছিল সে বুঝতে পারে না। সে একদিন পপিকে ফোন দিয়ে তার সাথে দেখা করতে চায়। পপি তাকে গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বলে। রিমার বিশ্বাস ছিল তার কথা শোনার পর পপি তার প্রস্তাবে অস্ম্মত হতে পারবে না। ঠিকই ভেবেছিল। তার প্রস্তাবে পপি রাজী হয়ে যায়। রিমা দেলোয়ারকে ডীভোর্স করে বাচ্চাদের নিয়ে বিদেশে কোথাও চলে যাবে। পপি তাকে সাহায্য করবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরী করতে এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে। কিন্তু দেলোয়ার সেই ব্যাপারে কিছুই জানতে পারবে না। পপি তার কথা রেখেছিল। রিমার হাতে চলে এসেছিল সব কাগজ পত্র, পাসপোর্ট, প্লেনের টিকেট আর একটা বিদেশী ব্যাঙ্কে ত্রিশ হাজার ডলার। পপি এটাও প্রতিজ্ঞা করেছিল সে নিশ্চিত করবে দেলোয়ার যেন কখন তার বাচ্চাদের পিছু না নেয়। সবকিছু একেবারে পরিকল্পনা মাফিক হয়ে গিয়েছিল।
নোমান মৃদু হেসে মাথা দোলায়। “বুদ্ধিটা দারুণ ছিল!”
“হ্যাঁ, খুন হবার চেয়ে অনেক ভালো! পপি মানুষ ভালো ছিল না। আমাকে তার পথ থেকে সরানোর জন্য যে কোন কিছু করতে সে প্রস্তুত ছিল।”
“তারপর এলে কানাডাতে?” নোমান জানতে চায়।
“হ্যাঁ, টুরিস্ট হিসাবে। ঢোকার পর আমার সমস্ত কাগজপত্র ফেলে দিয়ে রিফিউজি ক্লেইম করি। কয়েক বছর পর দেখা হল মিন্টুর সাথে।”
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রবিন ঘুম থেকে উঠে পড়েছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রিমা তাড়াতাড়ি উঠল। “ছেলেটা মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে।”
নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখেই উঠে দরজার দিকে রওনা দেয় নোমান। “এতো রাত হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। ঝট করে সময় চলে গেল।”
“আবার একদিন চলে এসো,” রিমা আন্তরিকভাবে বলে। “পুরানো দিনের কথা রোমন্থন করার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই, তা সেই দিনগুলো সুখেরই হোক আর দুখেরই হোক।”
“যখন ইচ্ছে হয় জানিও আমাকে,” নোমান দরজা পেরিয়ে বাইরে পা রাখতে রাখতে বলে, তারপর দরজাটা বাইরে থেকে ঠেলে বন্ধ করে দেয়।
৪৬.
জিব্রানের জন্মের পর সপ্তাহও পোরে নি যখন ছেলেকে বুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আসে রিমা। ইতিমধ্যে বার দুয়েক এসে বাচ্চাটাকে দেখে গেছে দেলোয়ার। একগাদা জামা-কাপড়, খেলনা নিয়ে এসেছে প্রতিবার কিন্তু থাকে নি বেশীক্ষণ। হয় তার কোন বিজনেস মিটিং থাকত, নয়ত কোথাও যেতে হত, একটা না একটা অজুহাত সে দাঁড় করিয়ে ফেলত। যে মানুষটা নিয়মিত আসত সে ছিল নোমান। জানত কাজের মানুষেরা সব কিছুতে সাহায্য করতে পারবে না যেমন পস্টপরটেম ডিপ্রেশন। তার উপস্থিতি রিমার জীবন নিয়ে আসত আনন্দের ঝলক। তার সঙ্গ এবং সাহচর্য না পেলে সেই সময়টাতে রিমা সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারত না। সে হয়ে উঠেছিল তার জীয়ন কাঠি।
তারপর আচমকা এক সন্ধ্যায় তার জীবনে ঝড়ো বাতাসের মত এলো আরেক অভিশপ্ত ক্ষণ, যা তার জীবনের মোড় আবারও নতুন করে ঘুরিয়ে দেয়। সেটা ছিল গ্রীষ্মের এক দিন, উষ্ণ, ভ্যাঁপসা। প্রতিদিনের মতই নোমান কাজের শেষে এসেছিল। রিমা বাচ্চাকে খাইয়ে, গোছল সেরে ফায়জাকে নিয়ে পেছনের উঠোনে বসে চা খেতে খেতে দূরের আকাশে ভেসে থাকা মেঘে শেষ বিকালের চমৎকার আলোর খেলে দেখছিল। কাজের মহিলা ঘরের আলোগুলো সব জালিয়ে দিয়েছিল। রিমার অন্ধকার পছন্দ কিন্তু ফায়জা আবার অন্ধকারে ভয় পেত। উঠোনের দুটা উজ্জ্বল আলোয় বাইরের প্রাঙ্গনটাও আলোকিত হয়ে ছিল। ফায়জার বয়েস মাত্র তিন হলেও সে ভীষণ ছটফটে ছিল। উঠোনে ছুটাছুটি করে খেলছিল আর তার প্রিয় শিশুদের একটা গান গুনগুন করে গাইছিল। নোমান চোখ মুখ উজ্জ্বল করে মেয়েটার পিছু পিছু উঠোনময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। ফায়জার সাথে তার ছিল প্রাণের টান। রিমা হাসি মুখে দুজনার ছেলেমানুষি ছুটাছুটি দেখছিল।
হঠাৎ সামনের গেটে ধাম করে একটা শব্দ হল। প্রথমে একবার, ক্ষনিকের নীরবতার পর বেশ কয়েকবার। তারপর শোনা গেল চীৎকার চেঁচামেচি। শান্তিময় সেই সন্ধ্যার আমজটা মুহুর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। রিমা নিজের আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পড়েছিল, আশংকা করেছিল হয়ত পপির গুন্ডার দল শেষ পর্যন্ত তার বাসায় হামলা দিয়েছে। গাড়ীর ড্রাইভার বাসার দারোয়ান হিসাবেও কাজ করত। ছোটখাট গাট্টাগোট্টা মানুষ, চল্লিশের কোঠায় বয়েস, কিন্তু তিন তিন জন যুবক যখন বাসার উঁচু গেট ডিঙ্গিয়ে ভেতরে লাফিয়ে নামল তার তেমন কিছুই করার ছিল না।
রিমা তাকে চীৎকার করে ডেকেছিল কিন্তু সে যখন ব্যাঁথায় কঁকিয়ে উঠেছিল তার বুঝতে বাকী ছিল না তাকে নির্মমভাবে কেউ পেটাচ্ছে। কাজের মহিলা সামনে উঁকি দিয়ে পরিস্থিতি দেখেই বিকট এক চীৎকার দিয়ে পেছনের উঠোনে চলে এসেছিল। “আপা! তিনটা লোক, হাতে লোহার রড!”
নোমান ফায়জাকে ধরে রিমার কাছে দেয়, তারপর শান্ত মুখে তাদেরকে নিজের শরীরের আড়ালে রেখে দৃঢ়ভঙ্গীতে দাঁড়ায়। যে বিপদই আসুক তার বিরুদ্ধে লড়তে সে প্রস্তুত ছিল।
যে তিনজন যুবক গেট ডিঙ্গিয়ে বাসার সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল তারা পেছনের উঠোনে চলে আসে। তাদের নেতা ছেলেটির বয়েস ষোল-সতেরর বেশী মনে হল না, ছেলেমানুষি সুন্দর একখানা মুখ, ঘাড় সমান লম্বা চুল। তার পরনে ছিল ছেঁড়া জিন্স, হাতা কাটা টি শার্ট যার ফাঁক দিয়ে তার সদ্য গজিয়ে ওঠা বাইসেপ চোখে পড়ছিল। তার দৃষ্টিতে ছিল ঘৃণা, দুই ঠোঁটের ফাঁকে ক্রোধ। অসম্ভব এক বিদ্বেষ নিয়ে সে তাকিয়ে ছিল নোমানের দিকে।
সেই ছেলেটি ছিল রনক।
ভাইকে কয়েক বছর দেখেনি রিমা কিন্তু ওর সব সময় একটা বিশ্বাস ছিল রনক একটু বড় হলে বুঝতে পারবে ওদের বাবা রিমার সাথে অন্যায় করেছেন এবং সে হয়ত বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সেই আশা নিয়েই সে দিনযাপন করছিল।
“রনক!” ডেকে উঠেছিল সে।
রনক তার দিকে ফিরেও তাকায় নি। তার দৃষ্টি ছিল নোমানের উপর নিবদ্ধ। “হারামী!” গর্জে উঠেছিল সে। “আপুর জীবনটা তুই শেষ করেছিস!”
নোমান তাকে ভালো মতই চিনত। রিমার কোন ধারণাই ছিল না ওর জীবনের সব দুর্দশার সাথে সাথে নোমানকেও সহ্য করতে হচ্ছিল নানা ধরনের অত্যচার। আগের সেই বাসাতেই তখনও বাস করছিল সে। রনক এবং তার বন্ধুরা আগেও সামনা সামনি পড়ে গেলে তাকে নানাভাবে অসম্মান করেছে। রিমার কাছে সেসব নিয়ে কখন কিছু বলে নি সে। আরেকটা বিষয়েও সে রিমাকে কখনও কিছু বলে নি যেটা হচ্ছে রনকের মদ এবং ড্রাগসের সাথে জড়িয়ে পড়া।
রনকের দিকে এক নজর তাকিয়েই নোমান বুঝেছিল সে মাতাল হয়ে ছিল। তার দৃষ্টি ঘোলা, কথাবার্তা বাঁধ বাঁধ।
“শান্ত হও রনক,” নোমান বলেছিল। “সব ঠিক আছে। একটা চেয়ারে বস, তোমার আপুর সাথে কথাবার্তা বল। তোমার ভাগ্না-ভাগ্নীর সাথেও পরিচিত হও।”
“চাই না!” রনক গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে চীৎকার করে উঠেছিল। “জীবনে কত বড় হতে পারত আপু, আর তুই তাকে বারবণিতা বানিয়ে ছেড়েছিস। তুই একটা দালাল ছাড়া কিছু না। ঐ হারামী দেলোয়ারের কাছে আমার সহজ সরল বোনটাকে বেঁচে দিয়েছিস তুই। ঐ বাচ্চা দু’টা কার কে জানে? দেলোয়ারের নাকি তোর?”
রিমা হতবিহবল হয়ে গিয়েছিল। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর কন্ঠ হঠাৎ জমে গিয়েছিল, ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। এই কি তার ভাই যাকে ও এতোদিন অনেক উঁচু আসনে বসিয়ে রেখেছিল? এই ছেলে তার ভাই হতে পারে না।
“রনক!” দূর্বল কন্ঠে এই টুকুই সে বলতে পেরেছিল।