শুজা রশীদ : (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(পর্ব ৬)
৯.
সেই শব্দও কখন ভুলতে পারবে না।
রাত যখন গভীর হয়, অধিকাংশ মানুষ ঢলে পড়ে নিদ্রায়, থিতিয়ে পড়ে শহরের যত হৈ হট্টগোল, সবকিছু হয়ে পড়ে সুনসান, এক শ’ আশি পাউন্ডের একটা শরীর বিশ তলা থেকে নীচের কঠিন এসফল্টের রাস্তার উপর পড়লে যে শব্দ হবে তা বেশ দূর থেকেও পরিষ্কার শুনতে পাবার কথা। রিমা যা শুনেছিল সেটাকে বর্ণনা করা যায় একটা ভারী বস্তা মাটিতে ফেলার সাথে, সংক্ষিপ্ত এক শব্দের বিস্ফোরণ, দুটি দ্রুত গতিতে ছুটন্ত গাড়ীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে যে ধরণের শব্দের সৃষ্টি হয়।
ও ঘুমিয়ে ছিল। অন্তত ওর তাই ধারণা। অনেক রাত তখন, কিংবা অনেক ভোর- নির্ভর করবে কে কিভাবে চিন্তা করে তার উপর। যে ডাক্তার তার পোস্ট মর্টেম করেছিল তার অভিমত অনুযায়ী মৃত্যুর সময় ছিল সকাল ২টা এবং ৩টার মাঝে।
ঐ রাতে ভীষণ ক্লান্ত ছিল ও, সারাদিন দোকানে কাজ ছিল, বাসায় ফিরে রান্না-বান্না, বাচ্চাদের খাওয়ানো, থালা বাসন পরিষ্কার করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়, বিছানায় যেতে যেতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়।
জেগে ওঠে ধপ করে একটা শব্দ শুনে, দূরে কোথাও কিন্তু পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিল।
সময় এবং স্থান অনুধাবন করতে পারেনি।
তার ঠিক পরে কি হয়েছিল সে স্মরণ করতে পারে না।
তার পর প্রথম যা ওর মনে পড়ে সেটা হচ্ছে এক তরুণ প্যারামেডিক তাকে অক্সিজেন মাস্ক পরাচ্ছে। কারণটা ও বুঝতে পারে নি কিন্তু নির্দেষ মত কাজ করেছিল। তাকে বলা হয়েছিল কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নিতে। সে নিয়েছিল। অল্পক্ষণ পরে সেটি সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর কতক্ষণ পেরিয়ে গিয়েছিল ওর হিসাব ছিল না কিন্তু কোন এক সময় তার চেতনা ফিরে আসে, সে নিজেকে আবিষ্কার করে ৯ ক্রিসেন্ট টাউনের নীচের সিঁড়িতে নাইট গাউন পরে উপবেশিত অবস্থায়, তার চারদিকে মানুষের ভীড়। সারা এলাকার মানুষ যেন এসে ভীড় করেছে সেখানে, শত শত মানুষ। আর রাস্তায় সারি সারি পুলিশের গাড়ি আর ফায়ার ট্রাক। অবাস্তব!
মার্সেল ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল বেশ পরে, সকাল এগারোটার দিকে। ততক্ষণে ওকে ওর এপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, লিভিং রুমে বাচ্চাদের মাঝে চুপচাপ বসে ছিল। ছেলে দুটি, বিশেষ করে রবিন, এত মানুষ জন দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। ফায়জা নীরবে কাঁদছিল। মিন্টু ওর নিজের বাবা ছিল না কিন্তু সেই সাত বছর বয়েস থেকে ঐ লোকটিকেই সে তার বাবা বলে জেনেছে। রিমার আগের দুটি সন্তানকে পরম ভালোবাসায় গ্রহণ করেছিল মিন্টু, ভালোবেসেছিল অকপটে, পরিবর্তে ওরাও তাকে ভালোবেসেছিল হৃদয় থেকে। বিশেষ করে ফায়জা। মিন্টুর চোখের মনি ছিল সে, ওকে খুশী করবার জন্য এমন কিছু ছিল না যা সে করতে প্রস্তুত ছিল না, কখন তাকে সত কন্যা বলে পরিচয় দিত না। ফায়জা পছন্দ করত সেটা। ভাষায় প্রকাশ না করলেও তার হাবে ভাবে বোঝা যেত মিন্টুর ভালোবাসা তার কাছে ছিল অমূল্য। বন্ধুদের কাছে তাকে সে নিজের বাবা বলেই সবসময় পরিচয় দিয়েছে।
“মিসেস আহমেদ, এই হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত,” ডিটেকটিভ মার্সেল খুব দয়ার্দ্র কন্ঠে বলেছিল। মুহুর্ত আগেই নিজের পরিচয় দিয়ে তার সাথে একটা সংক্ষিপ্ত আলাপের অনুমতি চেয়েছিল সে। জানিয়েছিল এই জাতীয় ঘটনার পর কিছু রীতিনীতি আছে। তাকে সেগুলো মেনে চলতেই হবে। মাত্র কয়েকটা মিনিটের ব্যাপার। বীনিতভাবে জানতে চেয়েছিল সে উপবেশন করতে পারে কিনা। বসার পর, পকেট থেকে সেলফোন বের করে তার অনুমতি চেয়েছিল তাদের মাঝের আলাপটাকে রেকর্ড করবার। রিমা দিশেহারার মত মাথা দুলিয়েছিল, সেটাকে অনুমতি ধরে নিয়ে রেকর্ডীং শুরু করেছিল।
রিমার মনে হয়েছিল সে যেন কোন এক অরণ্যে হারিয়ে গেছে, তার মস্তিষ্কে শুধু শূন্যতা, বুঝতে পারছিল তার চারপাশে কি ঘটছে কিন্তু পুরোপুরি তার গুরত্বটুকু অনুধাবন করতে পারছিল না।
“মিসেস আহমেদ, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? একটু পানি দেব?” মার্সেল নরম গলায় বলেছিল।
রিমা মাথা নেড়েছিল। না, সে ঠিকই আছে। এই আলাপটা যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই ভালো। সে বুঝতে পারছিল যা ঘটছে সেটাই স্বাভাবিক। কারো স্বামী যদি হঠাত করে বিশ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে তাহলে পুলিশের তো কিছু প্রশ্ন থাকতেই পারে। তাতে অবাক হবার কিছু নেই। শুধু একটাই সমস্যা ছিল, যা ঘটেছে সেটাকে সে বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল সে যেন একটা ছায়াছবি দেখছে, অথবা কোন দুঃস্বপ্ন। যেকোন সময় ঘুম ভেঙে উঠে যাবে, অবাক হয়ে ভাববে কত বাস্তব মনে হয়েছিল স্বপ্নটাকে।
কতখানি সময় পেরিয়ে গিয়েছিল ওর ধারণা ছিল না। ডিটেকটিভ মার্সেলের অনেক প্রশ্ন ছিল, কিছু কিছু ভীষণ ব্যক্তিগত, কিন্তু সে বীণিতভাবে অনুরোধ করেছিল তার সব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য। তাহলে সে রিমাকে আর ভবিষ্যতে বিরক্ত করবে না। রিমা নিজের মত করে তার এই ভয়াবহ হারানোর দুঃখে শোক করতে পারবে। কেউ তাকে বিরক্ত করবে না। রিমার কোন ধারণা ছিল না নীচে, লবিতে, কয়েক ডজন সাংবাদিক ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল, যাকে পাচ্ছিল তাকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল। রিমার জীবনে ব্যাক্তিগত বলে আর কোন কিছুই কখন থাকবে না।
“তুমি বলেছিলে তোমার স্বামী মাঝরাতের দিকে ঘুমাতে যায়, ঠিক?” রেকর্ডীংয়ের সাথে সাথে মার্সেল নোটবুকেও কিছু কিছু তথ্য লিখছিল।
রিমা মাথা নাড়ে। এই একই প্রশ্ন এই নিয়ে তৃতীয়বারের মত করেছে ডিটেকটিভ। তার কি স্মৃতিভ্রম হচ্ছে নাকি পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের এটা একটা কৌশল? বুঝতে পারছিল না। মাথার মধ্যে অবশ লাগছিল। তার সমগ্র জীবনে সে কোন পুলিশের সাথে কখন কথা বলে নি। বলতে হয় নি। তাদেরকে সে কখন পছন্দ করে নি। দেশে থাকতে পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ততা ছিল সর্বজনবিদিত। ঘুষ নেয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের রক্ষক হিসাবে কাজ করা, বেআইনীভাবে হত্যা করা, মানুষকে ভয় দেখিয়ে অর্থ নেয়া – কোন কিছুতেই তারা কম ছিল না। তাদের প্রতি রিমার স্বাভাবিক একটা ভীতিবোধ ছিল। কোন পুলিশের মুখোমুখি সে কখন হতে চায়নি। আর তার ভাগ্যেই এই দুর্ভোগ হল। এক পুলিশের মুখোমুখি বসে আছে সে, বিরক্তিকর মনে হলেও একই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে বারংবার।
“না না, আমি ঘুমাতে গিয়েছিলাম,” ধৈর্য ধরে উত্তর দেয় রিমা। এই লোকটা তার উত্তরগুলো মন দিয়ে শুনছে না। “আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। বাচ্চারা ঘুমাতে যাবার পর আমিও বিছানায় চলে যাই।”
“তখন মিস্টার আহমেদ কি করছিল?” ডিটেকটিভ জানতে চায়।
এই প্রশ্নের উত্তরও রিমা আগে দিয়েছে। রিমা নিজের বিরক্তি ঢাকার চেষ্টা করে। “ও বেলকনিতে বসে ড্রিঙ্ক করছিল, আমার ধারণা। প্রত্যেক রাতেই ঘুমাতে আসার আগে ও একটু ড্রিঙ্ক করত।”
“কিন্তু গত রাতে সে ড্রিঙ্ক করছিল কিনা তুমি জান না?”
“না মানে ও প্রতি রাতেই তো করত। গতরাতে আমি নিজের চোখে দেখিনি, সেটা সত্যি। বিছানায় যাবার প্রায় সাথে সাথেই বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম ও বেলকনিতে আছে। হাঁটছিল আর বিড় বিড় করে কথা বলছিল।”
“কি বলছিল? শুনতে পেয়েছিলে?”
“না। মানে শুনতে পাচ্ছিলাম কথা বলছে কিন্তু কি বলছে বুঝতে পারি নি। ও সব সময় নিজে নিজে কথা বলত। আমরা তাই নিয়ে ওকে ক্ষ্যাপাতাম।”
“সে ঘুমাতে আসত কখন?”
“অনেক দেরীতে। দুইটা – তিনটার দিকে। ঘুমাতে পারত না।”
“তুমি বলতে চাইছ বিছানায় আসার পরও ঘুমাতে পারত না?”
“হ্যাঁ। রাতে বোধহয় এক-দুই ঘন্টার বেশি কখন ঘুমাত না। কোন কোন রাতে বিছানায় আসতই না। সারা রাত বেলকনিতে পায়চারী করত।”
“তার কি ইনসমনিয়া ছিল?”
“জানি না। ঐ সব নিয়ে আলাপ করত না। বলেছিলাম ডাক্তারের কাছে যেতে। বলত এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে। ও ঠিকই আছে। নতুন একটা ব্যবসা শুরু করবে তাই অস্থির হয়ে আছে।”
“আসলেই কি নতুন কোন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছিল?”
“জানি না। ঐ সব নিয়ে আমার সাথে কোন কথাই বলতে চাইত না। বলত ওর ব্যবসা নিয়ে কোন কিছু না জানাটাই আমার জন্য ভালো।”
মার্সেল নীরবে তার নোটবুকে কিছু একটা লিখল। “সে কি বেআইনী কিছু করছিল? তোমার জানা মতে।”
রিমা মাথা নাড়ে। দেশে মিন্টুর বাবা মায়ের নানা ধরনের ব্যবসা ছিল। তার কিছু কিছু হয়ত এখনও তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা চালায়। বছর দশেক আগে কানাডায় আসার পর থেকে এখানে বড়সড় একটা ব্যবসা গড়ে তুলবার চেষ্টা করছে তারা। অধিকাংশই সফল হয় নি। ও শুনেছে তারা কয়েক লক্ষ ডলার নাকি গচ্চা দিয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যাপার নিয়ে তার পরিবার খুব গোপনীয়তা বজায় রেখেছে সবসময়। মার্সেলকে সেসব নিয়ে কিছু বলে না রিমা। মার্সেল যদি কখন জিজ্ঞস করে তাহলে যা সামান্য জানে তা বলতে তার কোন আপত্তি নেই।
“কাজ কর্ম কি করত সে? সংসার চালানোর জন্য?”
“মাঝে মাঝে উবার চালাত। ড্যানফোর্থ এভেনিউতে ওর পরিবারের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। আগে সেখানেই কাজ করত। কিন্তু ওর ছোট ভাইয়ের সাথে মনে হয় কোন ঝামেলা হয়। তার পর থেকে ওখানে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।”
মার্সেল আপনমনে মাথা দোলায়, কিছু একটা লেখে, তার পর হঠাত করে বিষয় পরিবর্তন করে। “ওর পরিবারকে ওর মৃত্যুর কথা জানিয়েছ?”
রিমা মাথা নাড়ে। চেয়েছিল কিন্তু ভয় হয়েছিল তাদের ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। তাদের সাথে বছরের উপর হয়ে গেছে সে কোন কথা বলে নি। হঠাত করে কিভাবে ফোন করে এমন একটা হৃদয়বিদারক খবর দিতে পারে?
মার্সেল তাদেরকে ফোন দিল। তার সেলফোনের অপর প্রান্ত থেকে বেশ কয়েকটি আর্তচীতকার শুনতে পেল রিমা। তার নিজের তিনটি বাচ্চা আছে। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ যে কি ধরনের যাতনার হতে পারে সে বুঝতে পারে। ফোন রেখে দিয়ে মার্সেল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে। “এর চেয়ে কঠিন কাজ আর হয় না। প্রত্যেকবারই মনটা ব্যাথায় ভরে ওঠে।”
সে রিমার সাথে সেঁটে থাকা বাচ্চাদের দিকে তাকায়। ওড়নার নীচে মুখ লুকিয়ে অশ্রæ ঢাকার চেষ্টা করছিল ফায়জা। তার কান্না থেমেছে কিন্তু চুপি চুপি এখনও ফোঁপাচ্ছে। জিব্রানকে দেখে মনে হচ্ছে সে হতভম্ব, অনিশ্চিত। রবিন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার ভাইয়ের হাত ধরে আছে। নিশ্চয় ব্যাথা লাগছে, কিন্তু জিব্রান কোন আপত্তি করে না।
“ভাবিস না, রব,” সে চুপি চুপি ভাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে। “বাবা বেহেশতে চলে গেছে। এটা খুশির ব্যাপার।”
রবিন মাথা দোলায়। জিব্রানের কথাই তার কাছে সত্য।
“তোমাকে আমার কয়েকটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করতে হবে,” মার্সেল দ্বিধা নিয়ে বলে। “বাচ্চারা কি অল্প কিছুক্ষনের জন্য পাশের কামরায় যেতে পারে?”
রিমা ফায়জাকে তার রুমে পাঠিয়ে দেয়। দুই ভাইকে বলে বোনের সাথে থাকতে।
তারা চলে যাবার পর মার্সেল তার দিকে কিঞ্চিত ঝুঁকে পড়ে বিনীত কন্ঠে বলে, “এগুলো জিজ্ঞেস করতে আমি কখনই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না কিন্তু তারপরও জিজ্ঞেস না করলেও নয়।”
রিমা খানিকটা ধারণা করেছিল জিজ্ঞাসাবাদ এবার কোনদিকে মোড় নিতে পারে। তার লুকানোর কিছুই ছিল না। সে সাহসী মুখ করে তাকিয়ে থাকে। এমন একটা কিছু যে ঘটতে পারে সেটা কি সে একেবারেই আন্দাজ করে নি? মানুষটা অনেক দিন ধরেই একটু একটু করে পালটে যাচ্ছিল।
“মিসেস আহমেদ, তোমার স্বামীর সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল?”
“ভালোই। কিছু দিন ধরে একটু দূরত্ব তৈরী করেছিল। মাথার মধ্যে নানা জাতীয় চিন্তা ভাবনা চলছিল ওর। কিন্তু আমাদের দুজনের সম্পর্কে কোন ফাটল ধরে নি।”
“আরৃতোমাদের অন্য সম্পর্কৃবুঝতেই পারছ?”
রিমা একটু থমকে যায়। এই ধরনের প্রশ্নের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিল না। “ওর মন ঠিক এসবের মধ্যে ছিল না।”
“তোমাদের কি অনেক ঝগড়া ঝাটি হত?”
“মাঝে মাঝে। খুব বেশী না। কথা কাটাকাটি আরকি।”
“কি নিয়ে?”
“মাঝে মাঝে বাসার মধ্যে মদ খেত। রাতে বেশী শব্দ করত। বাজার টাজার করতে চাইত না। মাঝে মাঝে ড্রাগসও নিত। ঐসব নিয়ে।”
“কি ধরনের ড্রাগস?”
রিমা মাথা নাড়ল। “জানি না। আমি আন্দাজ করতাম ড্রাগ নিয়েছে। ওর হাব ভাব দেখে।”
মার্সেল চিন্তিতভঙ্গীতে মাথা দোলায়।
“ওর কি কারো সাথে পরকীয়া ছিল মনে হয়?”
“পরকীয়া?” রিমা কয়েক মুহুর্তের জন্য হতবাক হয়ে যায়। এই কথাটা তার কখন একবারের জন্যেও মনে হয় নি। মিন্টুর অনেক দূর্বলতা ছিল কিন্তু নারী তার একটি নয়। মেয়েদের সাথে ও বরং একটু লাজুকই ছিল।
রিমাকেই প্রথম তার সাথে আলাপ শুরু করতে হয়েছিল।
তখন ঢাকা গ্রোসারীতে মাত্র কাজ শুরু করেছিল। মিন্টু সিগারেট কিনতে আসত। দেখতে শুনতে ভালো, খেলোয়াড়দের মত শরীর, একটু লাজুক। মিন্টু এতো ঘন ঘন কেন সিগ্রেট কিনতে আসে বুঝতে বেশী দেরী হয় নি তার। লোকটাকে তারও ভালোই লাগত যদিও মনে মনে তার একটা সংকল্প ছিল বাচ্চারা যতদিন না বড় হয় ততদিন সে কারো সাথে নিজেকে জড়াবে না। নিজের দুটি সন্তানকে সে কোন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে না দেবার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। সত বাবাদের হাতে কিভাবে সত ছেলেমেয়েরা অত্যচারীত হয়, এমনকি যৌন হয়রাণীর শিকার হয় তার আতংকজনক কত গল্প সে শুনেছে। তারপরও মাসখানেক গড়িয়ে যাবার পরও লোকটা যখন নিজের থেকে আলাপ শুরু করতে পারল না তখন বাধ্য হয় তাকেই এগিয়ে যেতে হল। আবহাওয়া সংক্রান্ত একটা সাধারণ প্রশ্ন দিয়ে আলাপ শুরু করেছিল রিমা। তাতেই কাজ হয়। ক’দিন পরেই সাহসে বুক বেঁধে তাকে বাইরে লাঞ্চ করতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানায় মিন্টু।
“মিসেস আহমেদ, আমার প্রশ্নের উত্তরটা?”
“আমি জানি না। কিন্তু সে ঐ ধরনের মানুষ ছিল না।”
“আর তুমি? তোমার কি আর কারো সাথে সম্পর্ক আছে?”
এইবার রিমা চমকাল। এই লোকটার সমস্যা কি? এই ধরনের উল্টো পালটা প্রশ্ন করবার পেছনে তার উদ্দ্যেশ্য কি? “না! না! প্রশ্নই আসে না। তাকে আমি ভালবাসতাম। মানসিক কিছু সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক কি সমস্যা ছিল জানি না। কিন্তু তাতে তার প্রতি আমার ভালোবাসায় কোন ঘাটতি পড়ে নি। সেও আমাকে ভালবাসত। আমরা একটা দেশী গ্রোসারী দোকানে পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলাম।”
মার্সেল মাথা দোলায়। “অনেক রোমান্টিক মনে হচ্ছে! আরেক দিন পুরো গল্পটা শুনব। আচ্ছা, ভুলে যাবার আগে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করে নেই। তার কি কোন লাইফ ইন্সিওরেন্স ছিল?”
রিমা মাথা নাড়ে। চেইন স্মোকার ছিল, মদ খেত, ড্রাগস নিত, বয়েসটাও নিতান্ত কম ছিল না, তার জন্য লাইফ ইন্সিওরেন্স নিতে হলে নিশ্চয় প্রিমিয়াম আকাশচুম্বী হত। বছর খানেক আগে একবার বোধহয় এটা নিয়ে রিমার সাথে আলাপ করেছিল মিন্টু। কেন হঠাত করে আলাপটা উঠেছিল রিমার আজ আর মনে পড়ে না। ওটা কি রবিনের জন্মের ঠিক পর পর নাকি ওর মানষিক বন্ধ্যাত্ব ধরা পড়বার পর?
মার্সেল মাথা নাড়ে। “খুব খারাপ কথা। এই সময় সেই টাকাটা তোমার উপকারে আসত। তুমি একাকী কি এই সংসারটাকে চালাতে পারবে?”
হঠাত রিমার ভেতরে একটা হিম শীতল অনুভূতি হয়। এতক্ষণ এসব নিয়ে ভাবার সময় তার হয় নি। ঢাকা গ্রোসারিতে তার কাজ থেকে যা সে পায় তা দিয়ে সংসার চলবে না। সরকার রবিনের জন্য যে চাইল্ড বেনিফিট দেয় সেটা উপকারে আসবে কিন্তু সব মিলিয়েও মাসের এপার্টমেন্ট ভাড়াটাই উঠবে না।
এই প্রথমবারের মত তার মনে হয় এই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মিন্টু পালিয়ে গেছে। এই দায়িত্ব একাকী বহন করবার মত ক্ষমতা কি তার আছে? এখানকার কোন ডিগ্রি নেই, দেশেও পড়াশুনা শেষ করে নি, এমনকি ড্রাইভার লাইসেন্সও নেই, এই যুদ্ধ সে একাকী কিভাবে লড়বে?