স্বপন কুমার সিকদার : যে ব্যক্তিকে নিজ গৃহে বা সামজিক কোন অনুষ্ঠানে সাদরে আপ্যায়ন করা হয় তাকে অতিথি বলা হয়। প্রায় সব ধর্মেই অতিথি বা মেহমানকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কনফুসিয়াস বলেছেন “প্রতিটি বাড়ির মেহমান আপনার জন্য সুখ নিয়ে আসে”। জনাব রুমির মতে “যদি কোনো মেহমান আসে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন, কারণ প্রত্যেককেই বাইরে থেকে আপনার বাড়ির ভিতরে সুখ ও আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে”। পবিত্র বুদ্ধ ধর্মে অতিথির জন্য ভাল কাজ করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে “অতিথি দেব ভবঃ”। অর্থাৎ “অতিথি হলো দেবতা” (“Atithi devo bhavahÓ meaning ÒAtithi – the guest – is God”)। “জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়া তরে, গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে”- রবীন্দ্রনাথ ঠকুর কিম্বা “হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান, তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান”- আবদুল কাদির- এর কথায়ও একই কথাই প্রতিধ্বনিত হয়। Holy Christianity says, “Hospitality is a sacred duty”। পবিত্র হিন্দু ধর্মে অতিথি সেবা মানেই নারায়ণ সেবা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ইশ্বর”। চাণক্যের বাণী- “বাল বৃদ্ধ যুবা যেই হোক না অতিথি, গুরুজ্ঞান তার-ই সেবা গৃহস্থের রীতি”। পবিত্র ইসলাম ধর্মেও অতিথিকে যথেষ্ট গুরুত্ত¡ ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যেমন – “অভ্যাগত অতিথির যথাশক্তি সন্মান করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যই কর্তব্য” – আল হাদিস। “কেউ যদি বাড়ি নির্মাণ করে, তাহলে সেখানে মেহমানের জন্য বিশেষ ঘর বা কক্ষের ব্যবস্থা রাখতে হবে”। – সুরা-১১ হুদ, আয়াত: ৬৯। “তোমার শত্রু তোমার মেহমান হলে শত্রুর প্রতি এমনভাবে আতিথিয়তা প্রদর্শন করো যেন সে তোমার শত্রু হয়েও মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়”- মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)। “নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে” – বুখারি, হাদিসঃ ৬১৩৪ ইত্যাদি। অতএব, অতিথি শ্রদ্ধেয় ও সন্মানিত।

জীবনে এমন কিছু মানুষ আসে অতিথির মতো, রেখে যায় কিছু আবেগ। যেমন কবির কথায় –
“তুমি কে এলে গো, এমন দিনে…
এমন ঝড়ো ঝড়ো বরিযনে আমার এ কুঠির প্রাঙ্গনে…
আমার এই পাতার ছাওয়া কুঠিরে,
তুমি এলে এই প্রভাতে, বরষার স্নিগ্ধ ছোঁয়া লয়ে”। – ছায়া বসু
কোন কোন অতিথি আবার বেদনারও কারণ হয়। যেমন, ব্যথিতের আবেগ – “অতিথি পাখি হয়ে কারো জীবনে যেওনা। হয়তো তুমি তাকে কিছুদিন হাসাবে। কিন্তু তুমি যখন চলে যাবে আপন ঠিকানায়, সে সারা জীবন কাঁদবে শুধু তোমার বেদনায়”।

এক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সবাই অতিথি। এই পৃথিবীতে আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসি। তাই প্রস্থান আমাদের ব্যথিত করে। কাব্যকথায় – “এত সুন্দর ভুবন ছেড়ে চলে যেতে হবে, তবে কিসের এতো মায়ার বাঁধন,
সব কিছু আমার আমার করছি, কিছু যে আমার নয়।
চলে গেলে দুটো ফোঁটা চোখের জল ফেলবে। এর থেকে বেশি কিছু নয়।
এসেছি যে সবাই আমরা ক্ষণিকের অতিথি হয়ে” – রাসমনি
কোন অতিথিই কোনদিন অতিথিপরায়ণ গৃহস্বামীকে ভুলে যায় না। “অতিথি ছিলে তুমি ক্ষণিকের, অথচ তোমার অস্তিত্ব, দীর্ঘকালের” -ঋতুপর্না রায়। অতিথির স্মৃতিতে গৃহস্বামী থাকে দীর্ঘকাল।
ঋষি কবির কাছে অতিথি কত গুরুত্বপূর্ণ ও সন্মানিত, উনি তা প্রকাশ করেছেন উনার আকর্ষণীয় কাব্য ছটায়। যেমন-
“ওই শোনো গো, অতিথ বুঝি আজ, এল আজ। ওগো বধূ, রাখো তোমার কাজ, রাখো কাজ।
শুনছ না কি তোমার গৃহদ্বারে, রিনিঠিনি শিকলটি কে নাড়ে, এমন ভরা সাঁঝ!
পায়ে পায়ে বাজিয়ো নাকো মল, ছুটো নাকো চরণ চঞ্চল, হঠাৎ পাবে লাজ।

নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়, কভু নয়। ওগো বধূ, মিছে কিসের ভয়, মিছে ভয়!
আঁধার কিছু নাইকো আঙিনাতে,আজকে দেখো ফাগুন-পূর্ণিমাতে, আকাশ আলোময়।
নাহয় তুমি মাথার ঘোমটা টানি, হাতে নিয়ো ঘরের প্রদীপখানি, যদি শঙ্কা হয়।
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে, পান্থ-সনে। দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে, দুয়ার-কোণে।
প্রশ্ন যদি শুধায় কোনো-কিছু, নীরব থেকো মুখটি করে নীচু, নম্র দু-নয়নে।
কাঁকন যেন ঝংকারে না হাতে, পথ দেখিয়ে আনবে যবে সাথে, অতিথিসজ্জনে।
ৃ…. …..
সাজাও নি কি পূজারতির ডালা? এখনো কি হয় নি প্রদীপ জ্বালা, গোষ্ঠগৃহের মাঝ?
অতি যতেœ সীমান্তটি চিরে, সিঁদুর-বিন্দু আঁক নাই কি শিরে? হয় নি সন্ধ্যাসাজ?
ওগো বধূ, হয় নি তোমার কাজ, গৃহ-কাজ”? – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু এখানেই শেষ নয়। মহর্ষি কবি নিজেই বিচলিত অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে। যেমন –
“তোমার আসন পাতব কোথায়, হে অতিথি।

ছেয়ে গেছে শুকনো পাতায়, কাননবীথি।
….. …… …….
মাতবে আকাশ নবীন রঙের তানে তানে,
পলাশ বকুল ব্যাকুল হবে আত্মদানে—
জাগবে বনের মুগ্ধ মনে, মধুর স্মৃতি হে অতিথি”। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবি নজরুল নজরুল ইসলামও অতিথি আগমনে উনার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন বার বার। যেমন –
“ভবনে আসিল অতিথি সুদূর।
সহসা উঠিল বাজি রুমুরুমু ঝুমু
নীরব অঙ্গনে চঞ্চল নূপুর” – কাজী নজরুল ইসলাম।
“ঝরা ফুল দলে কে অতিথি, সাঁঝের বেলায় এলে কানন-বীথি\
ও চোখে কী মায়া, ফেলেছে ছায়া, যৌবন-মদির দোদুল কায়া।
তোমার ছোঁয়ায় নাচন লাগে, দখিন হাওয়ায়, লাগে চাঁদের স্বপন বকুল চাঁপায়,
কোয়েলিয়া কুহরে ক‚ ক‚ গীতি”\ – কাজী নজরুল ইসলাম

আবার কবি কাজী নজরুল ইসলাম অতিথিকে বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকেও দেখেছেন। যেমন- “অভাবের দিনে প্রিয় অতিথি আসার মত পীড়াদায়ক বুঝি আর কিছু নেই! শুধু হৃদয় দিয়ে দেবতার পূজা হয়তো করা যায়, কিন্তু শুধু-হাতে অতিথিকে বরণ করা চলে না”
বিশ্ব কবির হৃদয়কে ভাবাবেগ রুপ অতিথি আপ্লæত করেছে বারবার। উনি হৃদয় দিয়ে এই অতিথিকে স্বাগতম জানিয়েছেন বহুভাবে। যেমন –
“শরতে আজ কোন্ অতিথি, এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।
নীল আকাশের নীরব কথা, শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
বেজে উঠুক আজি তোমার, বীণার তারে তারে।
শস্যখেতের সোনার গানে, যোগ দে রে আজ সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর, অমল জলধারে।
যে এসেছে তাহার মুখে, দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুখে,
দুয়ার খুলে তাহার সাথে, বাহির হয়ে যা রে”। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (গীতাঞ্জলি)
বিশ্বকবির মতে, আমরা আমাদের শ্রদ্ধেয় ও সন্মানিত অতিথিকে সবসময় কাছে রাখতে চাই – যেতে দিতে মন চায় না। যেমন –
“ধরণীর প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর, ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
“যেতে নাহি দিব! যেতে নাহি দিব।” সবে কহে “যেতে নাহি দিব!”
প্রভাতে ঝরা শেফালীর পথ বেয়ে যে ক্ষনিকের অতিথি উনার হৃদয়ে এলো, বিদায়ে বিরহ ব্যথায় উনি ব্যথিত। যেমন –
“ওগো অকরুণ, কী মায়া জানো, মিলনছলে বিরহ আনো
চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানে, মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া। ” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মিলন ও বিরহ বা আসা ও যাওয়া জীবনের সাথী বা একই মুদ্রার এপিট ওপিট। তাই, হৃদয়ের অতিথি হউক বা সশরীরে অতিথি হউক, সাধ্যমতো অতিথিকে হৃদয় দিয়ে গ্রহন করার বা সেবা করার মহান ব্রত আমাদের থাকা বাঞ্চনীয় মনে করি।
আমি যখন সুনামগজ্ঞে বিএডিসিতে কর্মরত, জনাব দেবাশীষ নাগ ছিলেন সুনামগজ্ঞের মহকুমা প্রশাসক। একসাথে বিভাগীয় লঞ্চে ভ্রমনের অনেক স্মৃতিই আছে। জনাব নাগ, পরবর্তীতে জেলা প্রসাশকের গুরু দায়িত্বসহ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। উনার দুই সন্তানের মধ্যে এক সন্তান ডাক্তার হিসাবে বাংলাদেশে সরকারী দপ্তরে কর্মরত। অন্য সন্তান চাটার্ড একাউন্টেন্ট ও কানাডায় কর্মরত। স¤প্রতি উনি কানাডা এসেছিলেন। দীর্ঘদিন পর দেখা। অতিথির সাথে ক্ষনিকের জন্য আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়। উনি বললেন উনি এখনও কাজ করেন, স্বল্প সময়ের জন্য সন্তানকে দেখতে কানাডা এসেছেন এবং সহসা দেশে ফিরবেন। ঐসময় তোলা কিছু ছবি সন্মানিত পাঠকবৃন্দের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হলো। এই লিখায় কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। কোন ভুল-ত্রæটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কামনা করচ্ছি।
সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। ধন্যবাদ